রুই মাছের প্রাকৃতিক সংরক্ষণঃ
রুই মাছ বাংলাদেশের অতিপরিচিত, সুস্বাদু ও জনপ্রিয় মাছ। এটি Cypriniformes বর্গের Cyprinidae গোত্রভু প্রজাতি। এ গোত্রের মাছগুলো কার্প জাতীয় মাছ (carps) নামে পরিচিত। বাংলাদেশে রুই ছাড়া কাতলা, মৃগেল কালিবাউস প্রভৃতি কার্প জাতীয় মাছও পাওয়া যায়। এগুলোকে বড় কার্প জাতীয় মাছ বলে। বাংলাদেশের প্রায় সব কার বড় নদী (পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, হালদা) ও মূল শাখা নদীতে, কাপ্তাই হ্রদ এবং বিভিন্ন হাওরে রুই মা বিস্তৃত।
বড় নদীগুলো হচ্ছে রুই মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। মাছের খামারে লালন-পালন শেষে বাজারজাত করা হয়।গ্রীষ্ম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কালবৈশাখি ও ভরা অমাবস্যা-পূর্ণিম রুই মাছ নদীতে ডিম ছাড়ে। ডিম থেকে মাছের পোনা যখন আঙ্গুলের সমান বড় হয় (আঙ্গুলিপোনা) তখন সংগ্রহ মাছের খামারে লালন-পালন শেষে বাজারজাত করা হয়। বাংলাদেশের এসব অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক উৎস ক্রমশ ক আসছে (নদী দখল, ভরাট, অপরিকল্পিত বাঁধ, দূষণ ইত্যাদি কারণে), পানির গুণগতমানও নষ্ট হচ্ছে। ফলে মায়ে জিনগত বৈশিষ্ট্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । হ্যাচারির মাছ কখনও প্রাকৃতিক মাছের প্রতিনিধিত্ব করে না। বিজ্ঞানীরা তাই প্রাকৃতি পরিবেশ ও রুই মাছের আবাসস্থলের যথাযথ সংরক্ষণের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। অভ্যন্তরীন নদীগুলো থেকে প্রাকৃতিক মাছ পাওয়া দূরূহ হয়ে পড়েছে। এ কারণে, অন্ততঃ বিশুদ্ধ রুই মাছের সংরক্ষণে সবার নজর এখন বাংলাদেশের হল নদীর দিকে।
হালদা নদী বাংলাদেশের কেবল একমাত্র দেশি নদী নয়, এটি একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী যেখান থেকে মাছচাষ পোনার বদলে রুই মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করে নিয়ে যান। এসব ডিম থেকে ফোটানো পোনার বৃদ্ধি যতো দ্রুত বেশি হয় অন্য কোনো জায়গা থেকে সংগৃহীত পোনায় তা হয় না, হ্যাচারীতেতো হয়ই না। এ জন্য এক কেজি রেণুপোন দাম প্রায় ৬০ হাজার টাকা, যা দেশে ন্য জায়গার পোনার দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।(হালদা নদীকে তাই প্রাকৃতিজিনব্যাংক সমৃদ্ধ 'মৎস্য খনি' নামে অভিহিত করা হয। এ নদীসহ অন্যান্য স্থানে রুই মাছের প্রাকৃতিক সংরক্ষণে প্রথম কাজ হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রুই মাছের প্রাকৃতিক বিচরণ স্থলগুলোকে মৎস্য অভয়াশ্রম ঘোষণা করা। লক্ষ ও উদ্দেশ্য এবং জলাশয় ভেদে মৎস্য অভয়াশ্রম নিচে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।
১. মৌসুমি অভয়াশ্রম : নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছ বছরের নির্দিষ্ট সময়ে উপযুক্ত বা নির্দিষ্ট প্রজনন ক্ষেত্রে বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে নির্দিষ্ট আবাসে বিচরণ করে থাকে। তাই অবাধ প্রজনন ও বিচরণের জন্য সুনির্দিষ্ট জলাশয় বছরের নির্দিষ্ট সময়ে মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়। যেমন- হালদা নদীর মদুনা ঘাট এলাকা, কাপ্তাই লেকের লং জাদু ও বিলাইছড়ি এলাকা। এখানে হালদা নদীর সামান্য একটি অংশকে (মদুনা ঘাট এলাকা) অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। তাও মৌসুমি অভয়াশ্রম। কিন্তু এ নদীতে সারা বছরই কম-বেশি রুই মাছের আনাগোনা দেখতে পাওয়া যায়। যেহেতু নির্দিষ্ট সময় ছাড়া অন্য সময় এ নদী অরক্ষিত থাকে তাই মানুষ গোপনে সারা বছরই মা-রুই মাছ আহরণে ব্যস্ত থাকে । অতএব বিষয়টি পর্যালোচনা করে যথাশীঘ্র সম্ভব সম্পূর্ণ হালদা নদীকে সাংবাৎসরিক অভয়াশ্রম ঘোষণা করে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। দেশের অন্যান্য নদীতে মৌসুমি অভয়াশ্রম কার্যকর হলেও হালদা নদীকে রুই মাছের জন্য সাংবাৎসরিক অভয়াশ্রম ঘোষণা করতে হবে।
২. বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা : হালদা নদী রুই মাছের বিশুদ্ধ জিন সংরক্ষণে অবদান রেখে চলেছে।
তাছাড়া, এটি একমাত্র জোয়ার ভাটার নদী যা দেশেরই এক প্রান্তে উৎপত্তি লাভ করে দেশেরই এক স্থানে সমাপ্ত হয়েছে। জোয়ার-ভাটা সমৃদ্ধ অঞ্চল এমনিতেই খুব সমৃদ্ধ কিন্তু অত্যন্ত সংবেদনশীল অঞ্চল। সংবেদনশীলতা ধরে রাখতে পারলে রুইয়ের প্রজনন ও বিচরণ অব্যাহত থাকবে। এ কারণে হালদা নদীকে বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
আরও দেখুন...